উৎপল শুভ্র
ইংল্যান্ডের সঙ্গে গায়ানার যতটা পার্থক্য, ততটাই লন্ডনের সঙ্গে জর্জটাউনের। ওভালের সঙ্গে প্রভিডেন্সেরও যেমন কোনো তুলনাই চলে না। তারপরও ইংল্যান্ড-গায়ানা, লন্ডন-জর্জটাউন, ওভাল-প্রভিডেন্স সব কেমন গাঁথা হয়ে গেল বিনিসুতোর এক মালায়। বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে।
মাঝখানে এক যুগের ব্যবধান। তারপরও ওভালে বাংলাদেশের স্বপ্নের মতো শুরু দেখতে দেখতে চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছিল প্রভিডেন্সের সেই ম্যাচের টুকরো টুকরো সব দৃশ্য। ভেসে উঠছিল গায়ানা, জর্জটাউন, মোহাম্মদ আশরাফুলের অবিশ্বাস্য সেই ইনিংস…।
দুই ম্যাচের মিল-অমিলে পরে আসি। অন্য অমিলগুলো আগে বলে নিই। প্রথম বিশ্বের ইংল্যান্ডের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের গায়ানার যতটা তফাত, দুই দেশের রাজধানী লন্ডন ও জর্জটাউনের মধ্যেও তা-ই। দুই ম্যাচের ভেন্যু ওভাল আর প্রভিডেন্সও সেই বৈপরীত্যের পতাকাবাহী।
ক্যারিবিয়ানের যে কটি দেশ মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল, গায়ানাই সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম। বাকি সব কটি দ্বীপরাষ্ট্র, একমাত্র গায়ানাই তা নয়। সেটি পড়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। ব্রাজিলের সঙ্গে যে দেশের বিশাল সীমান্ত। ১২ বছর আগে অ্যান্টিগা থেকে জর্জটাউন এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সিতে হোটেলের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়েছিল ব্রাজিল সীমান্তের দিকে পথনির্দেশিকা। ব্রাজিলে তখনো যাওয়া হয়নি, গায়ানায়ও সেটিই প্রথম। লাতিন আমেরিকা নিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি ফুটবল দর্শকের মনে বাড়তি একটা মাদকতা কাজ করে। ওই পথনির্দেশিকাই তাই একটু রোমাঞ্চের ঢেউ তুলেছিল মনে—বাহ্, গাড়িটা ডানে ঘুরিয়ে দিলেই ব্রাজিল!
গায়ানায় সেবারই প্রথম। এখনো যা শেষ হয়ে আছে। নতুন দেশ দেখার রোমাঞ্চটা তো আগে থেকেই ছিল মনে। সেটি আরেকটু বেড়ে গেছে চারপাশের দৃশ্যপটে। ক্যারিবিয়ানের এই দ্বীপ থেকে ওই দ্বীপে ঘোরার পর গায়ানায় পা রেখে মনে হয়েছিল, যেন অন্য ভুবনে চলে এসেছি। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলমুখী যাত্রাপথ বাংলাদেশকেও মনে করিয়ে দিয়েছিল। রাস্তার পাশে টং দোকান, এখানে-ওখানে গর্তে জমে আছে জল, কোথাও–বা জঞ্জাল…। মানুষজন যা দেখছি, প্রায় সবই আমাদের মতো দেখতে। এটি অবশ্য কোনো বিস্ময় হয়ে আসেনি। আগে থেকেই যে জানতাম, গায়ানার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষই ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
সেটি ২০০৭ বিশ্বকাপ। ত্রিনিদাদে প্রথম ম্যাচেই ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ কাঁপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। উঠে গেছে সুপার এইটে। অ্যান্টিগার স্যার ভিভ রিচার্ডস স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সুপার এইটের প্রথম দুটি ম্যাচে বাংলাদেশ এমনই নাস্তানাবুদ হয়েছে যে কখনো কখনো সেটিকে ‘আশীর্বাদ’-এর বদলে ‘অভিশাপ’ বলে মনে হচ্ছে! সেই যুগল দুঃস্মৃতি সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশ দল পা রেখেছে গায়ানায়। সেখানেও ভিন্ন কিছু হবে বলে একদমই ভাবিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল। বিশ্বকাপ শুরু করেছে ফেবারিট হিসেবে আর বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে। ত্রিনিদাদে ভারতের বিপক্ষে জয়কে মনে হচ্ছে দূর অতীতের কোনো স্মৃতি।
ম্যাচের আগের দিন সাগরপাড়ের হোটেলের গা লাগানো সৈকতে পাশাপাশি দুটি ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে কথা বলছি অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। খুবই ম্রিয়মাণ শোনাচ্ছে কণ্ঠটা। আত্মবিশ্বাসের লেশমাত্র সেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একবার বললেন বটে, ‘এই বিশ্বকাপে অন্তত আরেকটা বড় জয় পেতে চাই’, কিন্তু সেটি যেন বলার জন্যই বলা। কথায় কোনো জোর নেই। কিছুক্ষণ পর সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সহ-অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফীসও যোগ দিলেন আড্ডায়। পরদিনের ম্যাচের বদলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ঐতিহ্য ও বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে আলোচনাতেই বেশি আগ্রহী দেখা গেল তাঁকে। এ থেকেই আমি যা বোঝার বুঝে নিলাম।
পরদিন বাংলাদেশের ইনিংসের অর্ধেকটা পর্যন্ত সেই বোঝায় কোনো সংশোধনী আনার প্রয়োজন দেখিনি। ২৫ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর ৪ উইকেটে ৯২। খেলাটা যে ওয়ানডে, ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং দেখে তা বোঝাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময় পার্থক্যের কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে পত্রিকার প্রথম সংস্করণের লেখার ডেডলাইনও মিলে গেল এর সঙ্গে। খণ্ডিত সেই ম্যাচ রিপোর্টে শম্বুকগতির এই ব্যাটিংয়ের সমালোচনা ছাড়া আর কী থাকবে! যা লেখার কারণে প্রথম সংস্করণের পাঠকদের তীব্র ক্ষোভ আর বিরক্তির কারণ হয়েছিলাম। ই-মেইলে সেটি অকুস্থলে পৌঁছেও দিয়েছিলেন অনেকে। বাংলাদেশ জিতে যাওয়ার পর সেটি বেসুরো লাগারই কথা, কিন্তু যখন ওই লেখা লিখেছি, তখন কেই–বা ভেবেছিল, শেষ ২৫ ওভারে বাংলাদেশ তুলে ফেলবে ১৫৯ রান!
যেটি সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের শাপভ্রষ্ট রাজকুমার মোহাম্মদ আশরাফুল নামে এক ব্যাটিং জিনিয়াসের কল্যাণে। এই কদিন আগেই এক পত্রিকায় পড়লাম, আশরাফুলের সেই ৮৩ বলে ৮৭ রানের ইনিংসটিকে বিশ্বকাপে তাঁর দেখা সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি দিয়েছেন তামিম ইকবাল। শুধু রান-বলের হিসাবে সেটির কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। লাতিন ফুটবল যেমন শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো থেকে বেরিয়ে সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনী চিন্তায় দর্শককে পাগল করে দেয়, দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে আশরাফুলের সেদিনের ব্যাটিংয়েও তেমনি দুঃসাহসী চিন্তার অভিনব প্রকাশ। প্রথাগত সব শট তো ছিলই, স্কুপ আর প্যাডল মিলিয়ে অদ্ভুত একটা শটে রীতিমতো দিশেহারা করে তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান বোলারদের।
গায়ানায় নেমেই উপমহাদেশের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিং শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিলটা অন্যখানে। প্রভিডেন্সের মাঝখানে যেন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে মিরপুরের উইকেট। সাকিব তখন দলে নবীন, তাঁর সঙ্গে আছেন আরও দুই বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক ও আবদুর রাজ্জাক। তিন বাঁহাতি স্পিনারের নাগপাশে হাঁসফাঁস করতে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা ম্যাচের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির অনেক আগেই আসলে লিখে দিয়েছিলেন সেই ম্যাচের ফল।
সেই জয়ের সঙ্গে কালকের জয়ের এখানেই অমিল। ওভালে ম্যাচের ৪/৫ ওভার বাকি থাকতেও একটু হলেও অনিশ্চয়তার হাওয়ায় দুলছিল ম্যাচ। আরেকটা বড় অমিলের কথা তো আগেই লিখেছি। ২০০৭ বিশ্বকাপের ওই ম্যাচে প্রভাত মোটেই দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়নি। কাল যেখানে শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, এটা বাংলাদেশেরই দিন। অমিল আছে আরও। ১২ বছর আগের ওই জয়ের কথা মনে হলেই যেখানে প্রথমেই আশরাফুলের কথা মনে হয়, কালকের জয় সেখানে ‘সবে মিলি করি কাজ’-এর এক আদর্শ উদাহরণ। সেঞ্চুরি দূরে থাক, আশির ঘরের কোনো ইনিংসও নেই—তারপরও ৩৩০ রানই যা বুঝিয়ে দিতে যথেষ্ট।
দুই জয়ের পার্থক্যের কথা বলতে গিয়ে ভেন্যুর কথাও এসেছিল। এখানে তো কোনো তুলনাই চলে না। প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের অভিষেকই সেই বিশ্বকাপে। সেই ১৯৩০ সাল থেকে টেস্ট ভেন্যু বৌর্ডাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে যেটি বানানোই হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম বিশ্বকাপ উপলক্ষে। আর ওভালের কী সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, ক্রিকেটের কত ইতিহাস লেখা এই মাঠে! আভিজাত্য আর ঐতিহ্যে একই শহরের আরেক মাঠ লর্ডস এগিয়ে থাকে সব সময়। তবে অমর ক্রিকেটীয় কীর্তির রঙ্গমঞ্চ হিসেবে ওভালই তো এগিয়ে।
স্মরণীয় কত কিছুই না দেখেছে এই মাঠ—
* ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচ।
* ডব্লু জি গ্রেসের টেস্ট অভিষেক এবং অভিষেকেই সেঞ্চুরি।
* লেন হাটনের ৩৬৪।
* জ্যাক হবস ও ডন ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট। কাকতালীয়ভাবে দুজনেরই শেষ ইনিংসে শূন্য।
বিশ্বকাপে কোনো স্পিনারকে ম্যাচের প্রথম ওভার করতেও প্রথম দেখেছে এই ওভাল। সেটি এই বিশ্বকাপেরই উদ্বোধনী দিনে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় অবশ্যই ওভালের বৃহত্তর পটভূমিতে একটা বিন্দু হয়েও স্থান পাবে না। কিন্তু এই বিশ্বকাপে বড় কিছু করে ফেললে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেটি একটা আলাদা অধ্যায় তো দাবি করবেই।
একটা কাজ তো এরই মধ্যে হয়ে গেছে। প্রথম তিন দিনে একতরফা বিরক্তিকর সব ম্যাচের পর চতুর্থ দিনে এসে বাংলাদেশের এই ম্যাচই তো প্রথম মর্যাদা রেখেছে বিশ্বকাপের। ৪৬ দিনের দীর্ঘ যাত্রায় স্মরণীয় আরও অনেক ম্যাচই হয়তো উপহার দেবে এই বিশ্বকাপ। তবে শুরুটা করে দেওয়ার জন্য বিশ্বকাপের কাছ থেকে একটু কৃতজ্ঞতা তো পাওনাই বাংলাদেশের!